অগ্নি রায়

 

শাহিদিল্লির বঙ্গম্যাগ

অগ্নি রায়



"তখন অবশ্য উড়ালপুল ছিল না লিফটের নিচে অনুষ্কার সর্জোরস সরস ছিল না...বুক অফ নলেজের পৃষ্ঠা ওল্টাও, দেখো একুশ নম্বর আকবর রোডের বাড়িতে উড়ছে তকদির কা চমকতা হুয়া তারা, রাজনীতির সার্কাস ফার্মা ভাঙ্গে...রূপকথার প্রচ্ছদে মির্জা গালিব ম্যায় তামাশা নহী দুনিয়া তামাশা হ্যায়..."
                                                                                                                     -    রবীন্দ্র গুহ

  তখন সবেমাত্র সরোজিনী নগর তার জীবন শুরু করেছে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগন্তুক পাঞ্জাবি সিন্ধ্রিদের সঙ্গে বাঁচবার তাগিদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। তখন বসন্তের রোদ্দুরে সস্তার তরকারি আর ছিট কাপড় বিক্রি করে আজকের ধনী দিল্লিবাসীদের পূর্বজন্মের নির্বাহ শুরু। স্বাধীনতার বয়স তখন চার। শাহি দিল্লির শুখা বাতাসে স্বপ্নের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে দেশ ছেড়ে আসার টাটকা হেমারেজ।

  ধু ধু মাঠ আর উঁচু-নীচু জমির মধ্যে চরম লু আছাড়ি পিছাড়ি খেত গ্রীষ্মে। বালুর ঝড়ে ঝরা পাতা গোল হয়ে ঘুরন্ত। শীতে কখনও কখনও নলের জলে বরফের অবয়ব। এখানেই গায়ে গায়ে ঘেঁষে গড়ে উঠেছিল শ’দেড়েক বাঙালি পরিবারের বসতি। কালক্রমে তাদের মধ্যে দু’টি সাহিত্য দল। প্রাচীনপন্থী দলের নেতা বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়, কল্লোল যুগের কবি হিসাবে তাঁর পরিচিতি। অন্য দল যেন একটু বামঘেঁষা। পচিশে বৈশাখ তাই দু’টি সাহিত্য সভা। সেই রেষারেষির মধ্যেই দিল্লি ইউনিয়ন অ্যাকাডেমি স্কুল-এর প্রিন্সিপ্যাল ব্রজমাধব ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে ‘অনামিকা সাহিত্য সভা’ শুরু হল পঞ্চাশের গোড়ায়। প্রায় দশ বছরের এই সাহিত্য আড্ডার কোন মুদ্রিত নথি নেই ঠিকই, কিন্তু এ-কথা আজও রাজধানীর প্রবীন বঙ্গ’ বাজার একবাক্যে মেনে নেয়, পঞ্চাশের দশকে প্রবাসে বাংলা সাহিত্য সৃজনে অভিভাবকের কাজ করে গিয়েছে অনামিকা। বারোয়ারি বাংলা উপন্যাস নামে এক চমকপ্রদ কনসেপ্টের জন্ম দিয়েছিল অনামিকার আড্ডা। প্রত্যেক মাসের একটি নির্দিষ্ট রবিবার দুপুরে এই আড্ডা বসত, যেখানে যে কোনও একজন, উপন্যাসের একটি পর্ব লিখতেন। পরের মাসে সেই পর্ব এগিয়ে নিয়ে যেতেন অন্যজন। 


 সভার সদস্যদের মুখ্য অংশ ছিলেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারের পদস্থ অফিসারেরা, যাঁরা সাহিত্যপ্রেমীও। পঞ্চাশের দশকের শেষদিকে ব্রজমাধববাবু ত্রিনিদাদ চলে যাওয়ায় আরও কয়েকবছর অনামিকার সভাপতিত্ব চালিয়েছিলেন মণি রায়(পেশায় চিকিৎসক)। মণিবাবু তাঁর এক প্রবন্ধেজানিয়েছেন, ‘অনামিকার আসরে যোগদান করেননি দিল্লিতে আগন্তুক এমন কোন কবি সাহিত্যিকের নাম করা কঠিন। ডঃ নীহাররঞ্জন রায়, প্রবোধ সান্যাল, প্রেমেন্দ্র মিত্র, মুজতবা আলি, সন্তোষকুমার ঘোষ আসতেন। ...প্রেমেন্দ্র মিত্র একদিন বলেছিলেন, আপনাদের সভাতে যেমন হয় তেমন কচুকাটা মন্তব্য সবার লেখা নিয়ে, যদি কলকাতাতে হত, একদিনেই সভা ভঙ্গ হয়ে যেত!’  অনামিকার বহু কাগজপত্র, মাসিক বারোয়ারি উপন্যাস, বিজয়প্রতাপ মিত্র(মুন্নাদা) মহাশয়ের পালিতা কন্যার বাড়িতে ছাপার আশায় রাখা ছিল। কিন্তু এখন তার কোনও খোঁজ পাওয়া যায় না। ১৯৬৪ সালে এই আড্ডা বন্ধ হয়ে যায় কোনও মুদ্রিত চেহারা না রেখেই।



     অনামিকার মুদ্রিত চেহারা না থাকলেও তার কাছাকাছি সময়ে কিন্তু প্রথম জনপ্রিয় মুদ্রিত পত্রিকা প্রকাশিত হয় ‘ইন্দ্রপ্রস্থ’ নামে। খুলনার জাতক আদিত্য সেন ওপার বাংলায় পড়াশুনা শেষ করে দিল্লি এসেছিলেন চাকরির তাগিদে। ‘হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড’ পত্রিকায় কাজ করার পাশাপাশি গোষ্ঠীবদ্ধ সাহিত্যচর্চা শুরু করেন তিনি। অর্থাভাবে ‘ইন্দ্রপ্রস্থ’ স্তব্ধ হয়ে গেলেও শিল্পপতি ও প্রযুক্তিবিদ দিল্লিবাসী বিকাশ বিশ্বাসের সঙ্গে শুরু করেন ‘উন্মুক্ত উচ্ছ্বাস’ নামে একটি পত্রিকা। যেটি এখনও চলছে। 

‘চিরাগ দিল্লির ধুল জঙ্গল তুলে সমস্ত
চাঁদ নিয়ে ফুলবাগান হচ্ছে।
পঞ্চশীল পার্কের পর্দাতোলা ঘরে ভিজে গালিচায়
ময়ূরযুবক পা নাচায়, শিষ দিতে দিতে চলে যায় বুনো
ভ্রমণকারিণী, কাউকে বলা যায় না
এসব উত্তেজনার কথা।’
-    রবীন্দ্র গুহ

  আজ, তিন থেকে ছয়, ছয় থেকে আট লেনে বিন্যস্ত হয়েছে রাজধানীর রাস্তা। যার দুপাশে কম্পিউটার অ্যানিমেশনের মসৃণতায় তৈরি হয়েছে হাই এন্ড পার্কিং প্লাজা, স্টেট অব আর্ট বায়ো পার্ক, অসংখ্য শপিং মল। সিএনজি আর সবুজের ঘনঘটায় উদ্ধার হয়ে গিয়েছে লুটিয়েনের দূষিত বাতাস। উপরে যোজনান্তর উড়ালপুল এবং নীচে সর্পক্ষিপ্র, বিস্তৃত মেট্রোরেলের মধ্যে ক্রমশ গতি বাড়াচ্ছে, রূপ বদলাচ্ছে দিল্লি।
তাহলে কি, ‘যত বড় রাজধানী, তত বিখ্যাত নয় এ হৃদয়পুর?’

আসুন এর উত্তর খুঁজতে সেই সদ্য স্বাধীন হওয়া শহরটির সময়গলি পার হয়ে, চলে আসি, সত্তর দশকের শেষে। লাইসেন্সরাজ, ইমার্জেন্সি, বেকারত্ব, হতাশা, নকশাল আন্দোলনের মুখ থুবড়ে পড়ার সেই দহনবেলায় দিল্লির সরাই রোহিলা স্টেশনে (দিল্লির এই ছোট স্টেশনটি থেকে রাজস্থানের ট্রেন ছাড়ে এখন) এসে বেঞ্চে বসি দু’পলক। কয়লার ইঞ্জিন থেকে গুঁড়ো এসে লাগছে চোখেমুখে। কিন্তু সেইসঙ্গে ভাসছে কবিতার গুঞ্জনও! ওই ব্যস্ত দেহাতি রেলস্টেশনের অনর্গল ক্যাকফোনির মধ্যে কে তুমি পড়িছ বসি ‘বাবরের প্রার্থনা’, ‘দিনগুলি রাতগুলি’, অথবা ‘পুরি সিরিজের কবিতা’? 

সৈয়দ হাসমত জালাল, হিমাদ্রি দত্ত, মনোজ ঘোষ, অরূপ চৌধুরি, তড়িৎ মিত্রের মত কবিতাপ্রাণ তরুণেরা আড্ডা দিতে আসতেন এই স্টেশনটিতে। আসতেন অপেক্ষাকৃত সিনিয়র গৌতম দাশগুপ্তও। কবিতা পড়া হত। কবিতা পত্রিকা প্রকাশ করার স্বপ্ন দেখা হত। ‘আসল কথা দিল্লির মত এক কঠিন কেজো শহরে নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য কবিতাই ছিল আমাদের অস্ত্র।’ প্রত্যেকেরই ছিল বিভিন্ন পেশা, সকলেই যে দিল্লির আদি বাঙালি- এমনটাও নয়। কিন্তু সাহিত্যমনস্কতার প্রশ্নে এক ‘প্ল্যাটফর্মে’ দাঁড়িয়ে। শুধু সরাই রোহিলা নয়, এঁরা চষে বেড়াতেন কিদোয়াই নদর থেকে লোদি কলোনি। চিত্তরঞ্জন পার্ক থেকে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠ। চলে যেতেন হিমাচলের পাহাড়ে জঙ্গলে। নিঃসন্দেহে পঞ্চাশের দশকের কলকাতার কবিরা এঁদের অনুপ্রাণিত করেছিলেন। এই তরুণদের কমিউন কাব্য যাপনের ফসল হিসাবে সত্তরের দশকের শেষ থেকে আশির মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে অজস্র সাহিত্য পত্রিকা। বালার্ক, অভিজ্ঞান, রাজধানীর কবিতা সংকলন, রাজধানীর গল্প সংকলন, উত্তরমেরু- সে সময়ে প্রকাশিত হতে থাকে একের পর এক দিল্লির সাহিত্যকর্মীদের মুখপত্র। অর্চন দাশগুপ্তের (বুদ্ধদেব বসুর কবিতা পত্রিকায় যাঁর লেখালেখির বুনিয়াদ, তবে জীবনের টানা চল্লিশ বছর তিনি কাটিয়েছেন দিল্লিতে, একমাত্র প্রকাশিত কবিতার বই-মিনারে জ্বলন্ত রোদ) সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘ত্রুবাদুর’ পত্রিকা কলকাতায় সাড়া ফেলে দিয়েছিল। ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত হয়ে ছ’বছর চলেছিল ‘ত্রুবাদুর’। ওই সময়েই শশাঙ্কশেখর মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘প্রাংশু’ পত্রিকা চিত্তরঞ্জন পার্ক থেকে। যে বাড়ির ছাদে নিয়মিত বসত আড্ডা। যোগ দিতেন কলকাতা থেকে আসা কবিরা। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শিশিরকুমার দাশ, কবি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের স্নেহ মেশান প্রশ্রয় ছিল এই তরুণ কবিদের জন্য। কলকাতা থেকে উৎসাহ দিতেন পূর্ণেন্দু পত্রী, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়রা। দিল্লি এলে আড্ডা তো লেগেই থাকত। 

  ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্স-এর টেলিকম বিভাগে কর্মরত সৈয়দ হাসমত জালাল বদলি হয়ে কলকাতা চলে যাওয়ার পর একটু কি ভাঁটার টান লাগল কবিতা নিয়ে এই আন্দোলনের স্রোতে?  যেন সবাই একটু একটু করে সরে গেলেন নিজের অক্ষ থেকে, বিচ্ছিন্নতাবোধে ভুগতে লাগলেন কবিরা। সংসার, পেশা, রাজধানীর দৈনন্দিন যুদ্ধে কিছুটা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তাঁরা।
‘ফাঁকা বলতে কিছুই থাকে না
রাশি রাশি খেলনা সাজায় কারা পথ আটকে রেখে
দৃষ্টি আটকায় এসে বিজ্ঞাপনে নিখুঁত মডেল
মুহুর্তেই ঢেকে যায় পথময় এপ্রিলের ফুল বনস্পতি’
-দিলীপ ফৌজদার 

মধ্যবর্তী শূন্যতাকে অতিক্রম করে আসুন নব্বইয়ের দশকে। আর্থিক উদারিকরণ যখন সবে তার খেল-তামাসা শুরু করেছে, বিশ্বায়ন ঘোমটা সরিয়ে রাজধানীকে দেখাচ্ছে তার দর্পিত নাকের নথ, এই সময়েই একটি কবিতা পত্রিকাকে ঘিরে আবার দলবদ্ধ হলেন একঝাঁক দিল্লির কবি। উত্তর-আধুনিকতার ধারণাটিকে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে যাঁরা খনি খুঁড়ে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করলেন তিন দশকের পুরোনো হাংরি আন্দোলনকে। যাদের ডানার ঝাপট শুনতে পাওয়া গেল উত্তরবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড, জামশেদপুর এবং খোদ কলকাতায়। কবি দীপঙ্কর দত্তের সম্পাদনা এবং উৎসাহে জন্ম নিল সর্বার্থেই অভিনব এক সাহিত্য পত্রিকা- ‘জিরো আওয়ার’।
  অথচ দিল্লি শহরে বাংলা ভাষা সাহিত্যের ফুলবাবু লেখক কবি পত্রকারের সংখ্যা কম ছিল না আশির দশক জুড়ে। কিন্তু সেগুলো কলকাতার শারদীয় কলকাকলির এক্সটেনশনমাত্র। জিরো আওয়ারের অন্যতম প্রধান প্রতিনিধি অরূপ চৌধুরির কথায়, ‘সেইসব লেখালেখির ভিতর দিল্লির ধূসর অতীতের মুঘলি আজম অথবা স্বাধীনতা পরবর্তীকালীন শহুরে ও আমলাতান্ত্রিক ভদ্রলোকের ন্যাকান্যাকা জেনানা জীবনযাপন ও আলগা এক সফিস্টিকেশনের অধিক কি পেয়েছি আমরা? ভারতবর্ষের ড্রইংরুম দিল্লি শহরের যে সব ছবি সেইসব প্রাক্তন লেখালেখিতে লক্ষ্য করা গেছে তা একান্তই ক্লিশে, পণ্য সাহিত্যের চলমান মিছিল।’

  সেইসব ‘ক্লিশে’-র বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে দিল্লি হরিয়ানার ফ্রিঞ্জে প্রান্তিক জনজাতির মুখের ভাষা, সংকট অস্তিত্বের শব্দ তৈরির চেষ্টা শুরু হল সাহিত্য পত্রিকাটিতে। নিষ্ঠুর লাবণ্যে ভরা লোকেল/টোপোগ্রাফির বর্ণনা তৈরি হল জিরো আওয়ারের পাতায়। শুরু হল হরিয়ানভি, উর্দু, বাংলা এবং মুখচলতি ইংরেজির মিশেলে এক অভূতপূর্ব সংকর ভাষা। ভাষাতাত্ত্বিক ভি ভোলেনশিনভ তাঁর Marxism and Philosophy of language গ্রন্থে যাকে বলেছেন ‘চিহ্ন দখলের লড়াই,’ সেটাই যেন শুরু হয়ে গেল। 

  সেই লড়াইয়ের এক কবি ও সৈনিক গৌতম দাশগুপ্ত (যাঁর কাব্যভাষার সঙ্গে প্রয়াত কবি অমিতাভ দাশগুপ্তের দূরদূরান্তেরও আত্মীয়তা নেই, যদিও গৌতমবাবু অমিতাভ দাশগুপ্তের ভাই) জিরো আওয়ারের ৩৪ নম্বর সংখ্যায় (ফেব্রুয়ারি ২০০৩) লিখলেন, ‘সাদ্দামের কুকুর আর চারজন ফিদাইন/ অথচ
রক্তকরবীর রাজা নিরুপায় দ্যাখে/ দমকলের স্বপ্ন চোখে নিয়ে বঁইচি গ্রামের ছেলে- (বঁইচি গ্রামের ছেলে)।  ওই সংখ্যাতেই সাহিত্যে নিম আন্দোলনের প্রধান পুরুষ রবীন্দ্র গুহ ‘বয়ামের মাছ, গলায় ঘুঙুর’ কবিতায় উচ্চারণ করলেন, ‘লোকাল ট্রেনে আলাপ মুহাব্বত মরদানগী মরমঝাঁপ/ বেহশতের হুরী বেসুমার বাহার শরীরের ডগা চামড়ায়/বুকের উপর বেঁজি ঘোরে ঘিয়ারঙের পদ্মগোখরো দোলে গুব্বারা...’। এই গুব্বারা অর্থাৎ বেলুনের অনুষঙ্গ আবার ফিরে এসেছে তার পরের সংখ্যায়। যেখানে দীপঙ্কর দত্ত তাঁর জোঁক কবিতায় সতর্কবার্তা জানালেন, ‘ব্যনানা ফ্লেভারড কন্ডোমগুলির কতটা ফুডভ্যালু জানিনা, গিঁট মেরে রাখবেন কেননা হাওয়া এখন এতটাই গরম তারা ফেঁপে ফেঁপে উঠতে পারে হার্ট শেপড লিটিল গুব্বারা। আর তখনই কয়ামৎ।...’
  একটা বিষয় পাঠকের কাছে স্পষ্ট হতে শুরু করেছিল। পুরনো ক্ষুৎকাতরতা, যৌনকাতরতাই ফিরে এসেছে নব্বই দশকের গোড়ায়, সম্পূর্ণ নতুন ভাষার পোশাক পরে, নতুন এক শহরে। যে ভাষা কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গ অথবা পূর্ববঙ্গেরও নয়। এই ভাষা ডায়াস্পোরার যন্ত্রণা বিরহ পাপ সংশ্লেষ নৃতত্ত্বকে হাইব্রিড ভঙ্গিতে ছুঁয়ে থাকার কথা বলে। এই প্রসঙ্গে দেখে নেওয়া যায় ‘হাওয়া ৪৯’ লিটিল ম্যাগের হাইব্রিড সংখ্যাটির কথা, যেখানে বাখতিন নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে নিষাদ হেমব্রেম একজায়গায় বলেছেন, ‘হাইব্রিড হল শৈল্পিক কায়দায় সংগঠিত এমন একটা প্রণালী যার ভেতর বিভিন্ন ভাষাকে একে অন্যের সংস্পর্শে আনা হয়, এমন একটি প্রণালী যার লক্ষ্য হল একটি ভাষার দ্বারা আরেকটিকে আলোকিত করা, অন্য ভাষা থেকে খোদাই করে বের করা তার জাগ্রত প্রতিমা।’  

  এই প্রতিমাকে জাগ্রত করে রাখার সাধানাতেই ১৯৯৩ থেকে ২০০৫ – এই বারো বছরে মোট ৩২টি সংখ্যা বের হয় জিরো আওয়ারের। দীপঙ্কর দত্ত জানাচ্ছেন, ‘এই পত্রিকায় লেখা চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বলে দেওয়া হত নতুন শব্দ, বাক্যবন্ধ তৈরি করুন। পতিত, গেঁয়ো, দেশজ, স্থানিক, অভিধানহীন এমনকি অ্যান্টিওয়ার্ডেরও খোঁজ করা হত। বাংলা পত্রিকার মাধ্যমে একটা কাউন্টার কালচার গড়ে তুলতে চাওয়া হয়েছিল দিল্লির বুকে।’ সে সময়ে উৎসাহের হাত বাড়িয়েছিলেন শিল্পী পৃথ্বীশ গাঙ্গুলি(তখন তিনি দিল্লিতে কর্মরত), মলয় রায়চৌধুরী, বারীন ঘোষাল, পুণ্যব্রত পত্রীর মত অনেক সমমনস্ক ব্যক্তিত্ব। 
চিত্তরঞ্জন পার্কে বড়ুয়াদের চায়ের দোকানে সপ্তাহে একদিন বসত তুমুল কবিতা- আড্ডা। সঙ্গে মাছের চপ আর আড়ালে জল মেশান ভদকা! জামশেদপুর, কলকাতা, শিলিগুড়ি-সহ বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কবি বন্ধুরা দিল্লি এলে, অবশ্যই হাজিরা দিতেন ওই চায়ের দোকানে। প্রতিবছর সদলবলে যাওয়া হত কলকাতা বইমেলা। একবার মেলার মাঠে বসে জিরো আওয়ারের কবিদের লেখার সঙ্গে ছবি এঁকে জেরক্স করে ২০০ কপি বিক্রি করেছিলেন পুণ্যব্রত পত্রী।
‘ইহ দিল্লির রাজধানী শহরে শাপলা হাতে
হাটার্স বন্ধুরা
আকাদেমীর দরজায় থুকায়’
-রবীন্দ্র গুহ
বড়ুয়ার চায়ের দোকানের সামনে তৈরি হল বাজার। ‘শূন্য প্রহর’-এর সন্ধানীরা তাই আড্ডার জায়গা বদলালেন। দীপঙ্কর দত্ত, অরূপ চৌধুরিরা খুঁজে বের করলেন দিল্লি হাটে বসবার একটি ঠেক। বিজলি গ্রিল স্টলের পাশে চারকোনা পাথরের টেবিল ঘিরে বাড়তে থাকে। পড়া হতে থাকে গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ। কিন্তু কিছু স্পর্শকাতরতা, প্রতিষ্ঠান বিরোধীতার প্রশ্নে কোনও সঙ্গীর সৎ না থাকার অভিমানে ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায় পত্রিকাটি।

  আড্ডা কিন্তু বন্ধ হয় না। বরঞ্চ যোগ দিতে থাকেন নতুন নতুন সদস্য। ইউনিসেফ-এর চাকরিসূত্রে ১৯৮১ সাল থেকে দিলীপ ফৌজদার হয়ে উঠলেন এই আড্ডার এক প্রধান মানুষ। পুরুলিয়ায় জন্ম হলেও অল্পবয়স থেকেই প্রবাসী(জিওলজি নিয়ে পড়াশুনা করেছেন পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে) দিলীপবাবুর যোগাযোগ এবং সখ্য কৃত্তিবাসের দামাল দিনরাতগুলির সঙ্গে। পাটনায় দীর্ঘদিন থাকার সূত্রে নিমডি বা চাইবাসায় ‘শক্তি’ সঙ্গ এবং তার স্মৃতি তাঁর সাহিত্যভাবনাকে কতটা প্রভাবিত করেছিল সে প্রশ্ন স্বতন্ত্র।
কিন্তু সদাহাস্যময়, চিরতরুণ(এখন তাঁর বয়স ৬৮, কিন্তু ছুটে বেড়ান দিল্লি থেকে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায়, লিটিল ম্যাগ স্টলগুলোতে পৌঁছে দেন পত্রিকা)। দিলীপ ফৌজদারের ইনার ডিসিপ্লিন সেই সময়ের সামগ্রিক ক্যাওসের মধ্যে নতুন একটি কবিতা পত্রিকার জন্ম দিল। একা দিলীপবাবুই নন। সঙ্গে জিরো আওয়ারের তুর্কিরাও শুধু নন। একে একে যোগ দেন প্রাণজী বসাক(জন্ম ১৯৫৬ সালে পশ্চিমবঙ্গের এক প্রত্যন্ত গ্রামে। পড়াশুনোর শুরু তুফানগঞ্জ, উচ্চশিক্ষা কোচবিহার শহরে। আই আই টি দিল্লিতে কাজের ফাঁকে ফাঁকে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে এবং বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় কবিতা ও গল্প লিখে চলেছেন। বিভিন্ন সময়ে তাঁর সম্পাদিত পত্রিকা ‘অবরোধবাসিনী’, ‘অনুরণ’, ‘অরুণদীপ’)। শর্বাণীরঞ্জন কুণ্ডু (পেশায় তথ্যবিজ্ঞানী শর্বাণীবাবুর জন্ম ১৯৫২ সালে।) দীর্ঘদিন ধরে নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের পরিচালক পরিষদের সদস্য। অধ্যাপনাও করেছেন জাকির হুসেন কলেজে, গণিতে। নেশা কবিতার। ‘প্রাস ও ব্রীহি,’ ‘জহ্নু’ পত্রিকার সম্পাদক। কৃষ্ণা মিশ্র ভট্টাচার্য(অসমের হাইলাকান্দিতে জন্ম ১৯৫৫ সালে) উচ্চশিক্ষা শিলচর ও গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৮৬ সাল থেকে দিল্লিবাসী। আইআইটি দিল্লির ‘অভিধা’ পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব নেওয়ার পর নিজস্ব পত্রিকা ‘আর্জব’-এর সম্পাদনা করেছেন। এবং আরো অনেক।

  ২০০৩ সালে নিম আন্দোলনের প্রধান পুরুষ রবীন্দ্র গুহ লিখে এনে ওই টেবিলেই পড়লেন তর্কাতীতভাবে তাঁর অন্যতম জনপ্রিয় দীর্ঘ কবিতা, যার নাম ‘দিল্লি হাটার্স’! এটি এখনও পর্যন্ত শুধু বহমানই নয়, আড্ডা তরুণতর হচ্ছে, প্রসারিত হচ্ছে দর্শন এবং দিগন্ত। প্রত্যেকবছর এই পত্রিকার উদ্যোগে সর্বভারতীয় 
বাঙালি কবিদের আমন্ত্রণ জানিয়ে দিল্লির বুকে করা হয় একটি করে কবিতা ক্যাম্প। জিরো আওয়ারে যে প্রথাভাঙা, শাস্ত্রবিরোধীতার কথা বলা হয়েছিল, দিল্লি হাটার্সে এসে তা যেন কিছুটা খোলা আকাশ পেয়ে গেল সম্পাদনার কৃৎ কৌশলে। আধুনিক রাজনৈতিক জাগরণে যাকে বলা হচ্ছে ‘ইনক্লুসিভ’ – দিল্লি হাটার্সও ঠিক সেভাবেই গিলে নিতে থাকল পাসের রাজস্থানের স্টলের ডাল বাটি চুর্মা, জম্মু ও কাশ্মীরের ওয়াজওয়ান, উত্তর পূর্বের থুপ্পাকেও। যে সব কবি, গল্পকার শনিবার করে এই আড্ডায় আসতে শুরুকরলেন তাঁদের অনেকেই এক বা একাধিক সাহিত্যপত্রিকা সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত(যেগুলির কয়েকটির কথা আগে বলা হয়েছে)। কিন্তু ‘দিল্লি হার্টাস’ পত্রিকা সবাইকেই একটা সাধারণ মঞ্চ দিল। ধারণ করল সাহিত্য ভাবনার বিভিন্নতা, টেনশন, নাগরিকতা, জীবনচর্চাকে। বিভিন্ন রাজ্যের কবিরা তো বটেই, খবর পেয়ে এখানে ঘুরে গেলেন মার্কিন কবি অ্যালেন গিনসবার্গের কবিতা সচিব - রোজেনথাল(২০০৪-এর জানুয়ারিতে এই ইন্টারঅ্যাকশনের আয়োজন করা হয়েছিল অবশ্য তাজ হোটেলে)। নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছেন বাংলাদেশের কবিরাও।




    শুধুমাত্র কবিতায় সীমাবদ্ধ না রেখে হাটার্সরা যেটা করতে চাইছেন এবং কিছুটা করেছেনও, সেটা হল দিল্লির বুকে ডায়াস্পোরিক সাহিত্য আন্দোলন। কৃষ্ণা মিশ্র  ভট্টাচার্যের কথায়, ‘যার কোন ম্যানিফেস্টো নেই, রয়েছে কিছু কিছু সিনড্রোম।’
  আসুন দেখে নেওয়া যাক কলকাতা থেকে দেড় হাজার কিলোমিটার দূরের এই সাহিত্যভাবনার কয়েকটি সিনড্রোম বা প্রবণতা। বলা হচ্ছে –

১. আমরা এই সময়, এই গ্লোবাল ফেনোমেনা, এই অস্থির মায়োপিক হল্লাবোল ধরতে চাইছি, ফলে ভাষায় আসছে সংকরায়ণ।
২. আমাদের কবিতায় কোন বারবাড্ ওয়্যার নেই।
৩. আমরা কেউ কারুর মত লিখি না।
৪. আমরা চাইছি rhyzomatic অর্থাৎ শুধু বড় বড় বৃক্ষ নয়, ছোট ছোট ঘাস, ঘাসবীজ, কিংবা ফুলগুলিও মাইক্রোস্কোপের নীচে ধরা পড়ুক।




পাদটীকা

দিল্লির বাংলা সাহিত্য পত্রিকা নিয়ে এই আলোচনার বাইরেও থেকে যাচ্ছে আরো কিছু প্রকাশনার প্রসঙ্গ, এই স্বল্প পরিসরে যেগুলির উল্লেখ করা যাচ্ছে না। তাছাড়া শুধুমাত্র প্রকাশনার খাতিরেই উল্লেখ, এই নাতিদীর্ঘ আলোচনাটির উদ্দেশ্য তা নয়। আপাতত একটা সুখবর, ‘জিরো আওয়ার’ বন্ধ হয়ে গেলেও তার সম্পাদক দীপঙ্কর দত্ত দিল্লিতে বসেই সদ্য সম্পাদনা শুরু করেছেন একটি ওয়েব ম্যাগাজিনের যার নাম ‘শূন্যকাল’। দিল্লির সাম্প্রতিক ধর্ষণকাণ্ডগুলির বীভৎসতাই এই ম্যাগাজিনের আঁতুড়ঘর। থিম নাম- ‘কাউন্টার রেপ কালচার’ ।
উৎসাহী পাঠক ক্লিক করে দেখতে পারেন – www.shunyakaal.yolastie.com




অগ্নি রায় পেশায় সাংবাদিক, বর্তমানে দিল্লি প্রবাসী। তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ব্যাগের মধ্যে নির্জনতা, সূর্যাস্তের সঙ্গদোষ, অনূদিত আফ্রিকার ছোটগল্প সংকলন তপ্ত দিন দীর্ঘ রাত্রি । সেলিনা হোসেনের গল্প সংকলনের সম্পাদনা করেছেন(ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট)। দৈনন্দিন রিপোর্টাজ ছাড়াও লেখেন ফিচার, ট্রাভেলগ, ইতিহাস আশ্রিত ধারাবাহিক।   

















পাঠকের মতামতঃ